- ইমারত বিধি না মেনে অট্টালিকা নির্মাণ
- রঙ পাল্টে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ভবন মালিকরা
ভূতাত্তিক অবস্থান ও ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে সিলেট প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ। এ অঞ্চল বড় ধরনের ভূমিকম্পের মুখোমুখি হতে পারে। ঘন ঘন মৃদু ভূ-কম্পন বড়ো ভূমিকম্পেরই পূর্বাভাস বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষ করে রোববার দুপুর সোয়া ১২টার পর সিলেটে ফের ভূমিকম্প হয়।সুনামগঞ্জের ছাতকেই এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪। মাত্র্রা কম হলেও উৎপত্তিস্থলের কারণে এই ভূমিকম্পকে সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে,ভারতের আসাম, মেঘালয়, ডাউকি এলাকায় অনেকগুলো সক্রিয় ফল্ট রয়েছে। এসব ফল্ট প্রায়ই ঝাঁকুনি দিয়ে সরে যেতে চাচ্ছে। এতে প্রায়ই ছোট ছোট ভূ-কম্পন হচ্ছে। এতে বুঝা যায় এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।’
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে ২০১৯ সালে নগরীর ২৪টি ভবনকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেখিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। তালিকায় থাকা চারটি ভবনকে অপসারণ এবং আরও দুইটি ভবনকে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সংস্কার করা হয়। এরপর দীর্ঘ ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বাকি ১৮টি স্থাপনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সিসিক। এসব স্থাপনার মধ্যে বাসাবাড়ি, বিদ্যালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। নগর প্রশাসনের এমন দুর্বলতাকে পুঁজি করে উল্টো খোলস পাল্টে ফেলা হয়েছে এসব স্থাপনার। রঙ দিয়ে পুরনো এসব ভবনকে সাজানো হয়েছে নতুন রূপে। এতে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব স্থাপনায় বসবাস করছেন মানুষজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। এই অবস্থায় নির্বিকার সিসিক। অনেকটা ভুলেই গেছে ভূমিকম্পের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ এই তালিকার কথা।
সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার এলাকায় জরাজীর্ণ বিপনী বিতান ‘রাজা ম্যানশন’। ২০১৯ সালে কয়েকদফা ভূমিকম্পের পর নগরে জরিপ চালিয়ে আরও কয়েকটি ভবনের সাথে এই ভবনকেও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। সে সময় ওই ভবন ভেঙে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের অভিযানের পর কয়েকদিন বন্ধ থাকে রাজা ম্যাশন। এরপর রং পাল্টে হলুদ রূপে ফের খুলে দেওয়া হয় এই মার্কেট। রং পাল্টে এখনও বহাল রয়েছে রাজা ম্যানশন।
একই অবস্থা জিন্দাবাজারের বহুতল ভবন ‘মিতালী ম্যানশন’-এরও। ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় থাকা এ ভবনটির রং পাল্টে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ছয় বছর আগে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া এসব ভবনের ব্যাপারে এখন নির্বিকার সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ সিলেটে এসব ভবন ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালে কয়েকদফা ভ‚মিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় সিলেট নগরের ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন ভেঙে ফেলা, সব বহুতল ভবনের ভ‚মিকম্পসহনীয়তা পরীক্ষাসহ কিছু উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। তখন কয়েকটি ভবন বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর নগরের ২৫ টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক।
ওইদিনই নগরের সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশন নামের ৭টি বিপনী বিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সময়ে নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। আর নির্ধারিত ১০ দিন পর কোনো সংস্কার ছাড়াই খুলে দেওয়া হয় বন্ধ করা ভবনগুলো।
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ১০টি অতি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শুনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।
সিসিকের তালিকানুযায়ী, নগরীর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবনগুলো হলো- কালেক্টরেট ভবন-৩, সমবায় ব্যাংক ভবন মার্কেট, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজার এলাকার সিটি সুপার মার্কেট, মিতালী ম্যানশন, দরগা গেইটের আজমীর হোটেল, মধুবন মার্কেট, কালাশীল এলাকার মান্নান ভিউ, শেখঘাটের শুভেচ্ছা-২২৬, চৌকিদেখী এলাকার ৫১/৩ সরকার ভবন।
যতরপুরের নবপুষ্প-২৬/এ, জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশন, পুরানলেন এলাকার ৪/এ কিবরিয়া লজ, খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গালের মেঘনা-এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ী এলাকার ওয়ারিছ মঞ্জিল একতা- ৩৭৭/৭, হোসেইন মঞ্জিল একতা- ৩৭৭/৮ ও শাহনাজ রিয়াজ ভিলা একতা- ৩৭৭/৯, বনকলাপাড়া এলাকার নূরানী-১৪, ধোপাদিঘী দক্ষিণপাড়ের পৌর বিপনী ও পৌর শপিং সেন্টার, এবং পূর্ব পীরমহল্লার লেচুবাগান এলাকার ৬২/বি- প্রভাতী, শ্রীধরা হাউস।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, সিলেটে যেকোনো সময় বড় ধরণের ভ‚মিকম্প হতে পারে। এতে ধ্বসে পড়তে পারে বেশিরভাগ বহুতল ভবন। তাই বহুতল ভবনগুলো ভেঙে ফেলা বা সংস্কার এবং নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে সিলেটের অধিকাংশ স্থাপনাই উচ্চ মাত্রার ভ‚-কম্পন সহ্য করতে সক্ষম নয়। সিলেট শহরে প্রায় ৪২ হাজার ভবন রয়েছে। এসবের বেশিরভাগই পুরনো ও দুর্বল, যেগুলো মাঝারি মাত্রার ভ‚মিকম্পেই ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সিলেট শহরে গড়ে উঠা প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভবন নির্মাণে যথাযথ বিধিমালা মানা হয়নি। ফলে ভ‚মিকম্প হলে এ অঞ্চলে বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।’
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সীমান্তের ডাউকি ফল্ট। যাকে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলা হয়। ২০২১ সালের মে মাসে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে ১০ দফা ভূমিকম্প হয়, তার উৎপত্তিস্থল ছিল এই ফল্ট। সবশেষে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ভারতের আসামের উদলগুড়ি থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে। রিকটার স্কেলে যার মাত্রা ৫.৮। সে হিসেবে সিলেট লাগোয়া ভারতের এসব রাজ্যে ভূমিকম্পের বেশ কয়েকটি ফল্ট সক্রিয়। এসব ফল্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে দুশ্চিন্তার বড় কারণ। আসামের এই ভ‚মিকম্প সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের দুটি উৎস আছে। একটি উত্তরের দিকে আছে, আরেকটা হচ্ছে পূর্ব দিকে। উত্তরের দিকটা হলো ডাউকি ফল্ট (ডাউকি চ্যুতি)। রোববারের যে ভূমিকম্প হলো, সেই হিমালয়ন মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট বেল্টে। সেটা আমাদের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎসস্থল ডাউকি ফল্টেরই কাছাকাছি।’
তিনি বলেন, সিলেট থেকে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই অংশটা খুব বিপজ্জনক। কেন না এখানে হাজার বছরের ওপরে বড় ভ‚মিকম্প হয়নি। অর্থাৎ যে শক্তিটা জমা হয়ে রয়েছে বা ক্রমাগত জমা হচ্ছে, গত এক হাজার বছরেও এটা শক্তিটা ছাড়েনি। এটা যেকোনো সময় বড় আকারের ভ‚মিকম্পের স্থান হয়ে উঠতে পারে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এখানে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। আর এটি যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ৭টি ভ‚মিকম্পের উৎপত্তিস্থলই ছিল সিলেট বিভাগের, গোলাপগঞ্জ, জগন্নাথপুর, মাইঝবাগ ও নবীগঞ্জে। এছাড়াও গেল দুই বছরে সিলেট ও এর পার্শবর্তী অঞ্চলে প্রায় দেড় শতাধিকের চেয়ে বেশি ভূমিকম্প অনুভুত হয়েছে বলে জানিয়েছে সিলেটের আবহাওয়া অফিস।
সিলেটের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ভূমিকম্প হলে সিলেটের ৭৫ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে পুরোনো ভবনগুলোর বেশি ক্ষতি হবে। তবে আমাদের যন্ত্রপাতির কোনো অভাব নেই। সে হিসেবে ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি আছে। কিন্তু সিলেট শহরের অধিকাংশ ভবন নিয়ম না মেনেই তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে বা কোনো দুর্ঘটনা হলে দ্রুত জায়গায় যেতে হলে সমস্যা হবে। তবে ভূমিকম্প নিয়ে মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি অন্তত পাঁচ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরি এবং তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

নিজস্ব প্রতিবেদক 



















