সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর লুটপাট ও চুরির মামলা আতংকে বাড়ি ঘর ছাড়া হাজার হাজার মানুষ। সাধারণ শ্রমিক শ্রেনী থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী ঘর বাড়ি ছেড়ে পলাতক আছেন। বিশেষ করে অনেক দলের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও পলাতক আছে। গত বছরের ৫ আগষ্টের পর থেকে শুরু হয় ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর লুটপাট। কিন্তু গত ২৬ জুলাই পাহাড়ি ঢলের ফলে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর থেকে লুটপাট অনেক বেশি হয়ে যায়। এরপর নড়েচড়ে বসে সিলেট জেলা প্রশাসন। তারপর থেকে শুরু হয় পাথর আইনি প্রক্রিয়া। গত ১৫ আগষ্ট খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক আনোয়ারুল হাবীব সাক্ষরিত অভিযোগের ভিত্তিতে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। কোম্পানীগঞ্জ থানার মামলা নং-০৯ তা; ১৫-০৮-২০২৫। অভিযোগে বলা হয়, কোয়ারি হতে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে মর্মে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পাথর লুটপাটে অজ্ঞাতনামা আনুমানিক ১৫০০-২০০০ ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সরকারের গেজেটভুক্ত কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরি এ ধরনের কর্মকান্ড খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এর ধারা ৪(২)(ঞ) এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২ এর বিধি ১৩(১) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মৌখিক নির্দেশনায় খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯১২ এর এ ধারা অপরাধে ও দন্ড বিধি ১৮৬০ এর ৩৭৯ নং ধারা ও ৪৩১ নং ধারায় অভিযোগ দায়ের করা প্রয়োজন।
এমতাবস্থায়, সরকারি নির্দেশনায় ও সরকারি স্বার্থে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরির দায়ে দায়ী (অজ্ঞাতনামা) ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
উল্লেখিত অভিযোগের ভিত্তিতে কোম্পানীগঞ্জ থানার মামলা নং-০৯ তারিখঃ ১৫-০৮-২০২৫ তারিখে মামলা রুজু করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় কোম্পানীগঞ্জ থানার অজ্ঞাত আসামির আটকের অভিযান। গত ২ দিলে ৯ জনকে আটক করেছে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ।প্রতি রাতে বলেন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান হচ্ছে। মামলা আতংকে কলাবাড়ি, কালীবাড়ি, দয়ার বাজার, বালুচর এবং ভোলাগঞ্জ, গুচ্ছগ্রাম, রুস্তমপুর গ্রামগুলো বর্তমানে পুরুষ শুন্য।
শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা পেটের দায়ে পাথর আনতে যায়। আমাদের এলাকায় পাথর ও বালু ছাড়া কোনো কর্মসংস্থান ও নাই। বউ বাচ্চা নিয়ে জীবন ধারণের জন্য পাথর আনতে যাই। কিন্তু থানায় অজ্ঞাত নামা মামলায় আমরা খুবই ভয়ে আছি। আমরা রাতে বাড়িতে থাকতে পারি না।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে ও আলাপ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রাশার মিল ব্যবসায়ী বলেন, আমি আমার ক্রাশার কোনোদিন সাদা পাথর ক্রাশ করি নাই। আমি একজন এলসি ব্যবসায়ী। কিন্তু প্রশাসন আমার ক্রাশার মিলের বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দিচ্ছে। এরচেয়ে ভয়ংকর বিষয় গত পরশু অজ্ঞাত নামে ১৫০০/২০০০ মানুষের নামে মামলা হয় যা আমাদের কে আতংকে রাখছে।
আরেকজন বলেন, আমি ক্রাশার মিল ব্যবসায়ী। নদী থেকে পাথর কয়েক হাত বদল হয়ে আমার কাছে আসে। এখন যদি আমার নামে মামলা হয় আমি ও আমার পরিবার পথে বসে যাবে।
একই অবস্থা উপজেলার সর্বত্র বিরাজ করছে। আরকেজন বলেন, নদী থেকে পাথর উত্তলন করতে না দিলে তো আমরা ক্রাশার ব্যবসায়ীরা পাথর কিনতে পারতাম না। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভুমিকা খুবই দুর্বল। প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করে পাথর চুরি হয়েছে। যদি মামলা হয় আগে প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিৎ।
অনেকেই দাবি করছেন, যারা জড়িত তাদের নামে মামলা হইলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারতাম কিন্তু অজ্ঞাত নামে হওয়ার আমরা খুবই আতংকে আছি।
এদিকে সাদা পাথরের প্রকৃত লুটেরা ও তাদের মদতদাতাদের আইনের আওতায় না এনে গরিব দিনমজুরদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখা । শনিবার (১৬ আগস্ট) বিকেল ৫টায় নগরীর কোর্ট পয়েন্টে সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এই অভিযোগ করেন।
সিলেটে নদী, পাহাড় ও প্রকৃতিকে শাসক-শোষক গোষ্ঠীর লুণ্ঠন থেকে রক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সরকার এবং পরিচালনা করেন যুগ্ম সম্পাদক রমজান আলী পটু।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটন স্পট থেকে শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। অথচ প্রকৃত লুটেরা ও তাদের মদতদাতাদের আইনের আওতায় না এনে উল্টো গরিব দিনমজুরদের হয়রানি করা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাঁরা মূলত চুনোপুঁটি, অথচ রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
বক্তারা আরও বলেন, অভিযানের নামে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বারকি শ্রমিকদের নৌকা ভেঙে দিয়েছেন। একের পর এক নৌকা ধ্বংস হতে দেখেও অসহায় শ্রমিকরা কিছু করতে পারেননি। এতে তাদের জীবিকার একমাত্র ভরসা নষ্ট হয়ে গেছে।
তারা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আশির দশক পর্যন্ত সিলেটে সনাতন পদ্ধতিতে (বেলচা, বালতি, নেট) বালু-পাথর আহরিত হতো। এই পদ্ধতি পরিবেশের জন্য হুমকি নয়, বরং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষা করত। আধুনিক লুটপাটমুখী পদ্ধতিই আজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে বলে জানিয়ে বালি-পাথর মহালে ইজারা প্রথা বাতিল, সনাতন পদ্ধতিতে বারকি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, সরকারিভাবে ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র চালু, সাদা পাথর লুটের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।