সবুজ গাছ নয়, এ যেন বিজ্ঞাপনের বোর্ড! সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, এমনকি সরকারি ভবনের দেয়াল-সবখানেই ঝুলছে অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন ও সাইনবোর্ড। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, চিকিৎসক কিংবা ভর্তি কোচিং সেন্টার-সবাই মেতেছে প্রচারণার প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতার মূল শিকার হচ্ছে শহরের গাছপালা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে- শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট, বিলপাড়, ষোলঘর, রিভার ভিউ-সব এলাকায় শতবর্ষী গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে টানানো হয়েছে রঙিন ফেস্টুন। কোথাও কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন, কোথাও চিকিৎসকের চেম্বারের সাইনবোর্ড, আবার কোথাও রাজনৈতিক প্রচারণা। এমনকি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণ ও আদালত চত্বরের শতবর্ষী গাছগুলোও রেহাই পায়নি। সেখানে একেকটি গাছে ঝুলছে ৫-৮টি পর্যন্ত ব্যানার-ফেস্টুন!
রিভার ভিউ এলাকার একটি পুরোনো বটগাছের ডাল পর্যন্ত ছেঁটে ফেলা হয়েছে বিজ্ঞাপন দৃশ্যমান করার জন্য। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি, সিগন্যাল বাতি, ল্যাম্পপোস্ট এমনকি সরকারি-বেসরকারি ভবনের দেয়ালেও একই চিত্র-সবখানেই এক অগোছালো প্রচারণা!
সম্প্রতি শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেয়ালেও শুরু হয়েছে স্প্রে পেইন্টে বিজ্ঞাপন আঁকার প্রবণতা। দেখা গেছে, একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক ও এক নেতার নামসহ ‘এমপি হিসেবে দেখতে চাই’ লেখা স্লোগান আঁকা হয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাসভবনের দেয়ালেও। এমনকি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের প্রবেশপথেও টানানো হয়েছে একাধিক রাজনৈতিক ব্যানার ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিজ্ঞাপন।
এ নিয়ে শহরের একাধিক নাগরিক হতাশা প্রকাশ করলেন। নগরীর বিলপাড় এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়। অথচ আজ তাদের শরীরে অনায়াসে পেরেক মারা হচ্ছে। এটা শুধু গাছের প্রতি নয়, পরিবেশের প্রতিও নির্মমতা। পৌরসভা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
ষোলঘরের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ হতাশা নিয়ে বলছিলেন, ‘গাছে পেরেক মারা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু তবুও প্রতিদিন ঘটছে এমন কাজ। একসময় হয়তো এই শহরের সবুজ হারিয়ে যাবে।’
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন কিছুতেই এমনটা চাইছেন না, ‘শহরের সৌন্দর্য এখন ব্যানারের নিচে চাপা পড়েছে। ব্যবসা বা রাজনীতির নামে এমন পরিবেশ ধ্বংস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও পৌর শহরের বক পয়েন্টের বাসিন্দা আবুল হাসনাত জানাচ্ছিলেন, গাছের সঙ্গে প্রতিনিয়তই এই ধরনের অত্যাচার করা হচ্ছে। শহরের সকল সড়কের পাশের গাছগুলোতেই কোনো না কোনো ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলে আছেই। গাছের প্রতি এই নির্দয় আচরণ বন্ধ করা প্রয়োজন। এগুলো বন্ধ না হলে একদিকে শহর সৌন্দর্য হারাবে অন্যদিকে আমাদের গাছগুলো দিন দিন ধ্বংস হবে!
পরিবেশবিদদের মতে, গাছের গায়ে পেরেক ঠোকা মানে ধীরে ধীরে তার মৃত্যু ডেকে আনা। পেরেকের ছিদ্র দিয়ে পানি, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রবেশ করে; ফলে গাছের গায়ে পচন ধরে, খাদ্য ও পানি শোষণপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। মরিচা ধরা পেরেক আবার বিষের মতো কাজ করে-যা শেষ পর্যন্ত গাছকে মেরে ফেলে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘আমরা গাছকে ব্যবহার করি, কিন্তু তার প্রাণের কথা ভাবি না। গাছে পেরেক মারা মানে তার শরীরে আঘাত করা। এখনই উদ্যোগ না নিলে শহরের সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’
বিষয়টি স্বীকার করে সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক মো. মতিউর রহমান খান বলেন, ‘শহরে অনুমোদনহীন ব্যানার, ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন অপসারণের জন্য খুব শিগগিরই পৌরসভা থেকে অভিযান চালানো হবে। পরিবেশ ও শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
যে গাছের ছায়ায় শহর শ্বাস নেয়, সেই গাছই আজ শহরের নির্মমতার শিকার। সুনামগঞ্জে ব্যানার আর ফেস্টুনের দখলে হারাচ্ছে গাছের প্রাণ। শহরের গাছ এখন যেন বিজ্ঞাপনের ভারে যন্ত্রণায় কাবু! অথচ এই গাছই শহরের অক্সিজেনের উৎস, তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষাকারী এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রশাসন ও নাগরিকরা যদি এখনই সচেতন না হন, তবে আগামী প্রজন্ম হয়তো শুধু ছবিতেই দেখবে সুনামগঞ্জের সবুজ ছায়াঘেরা পথ!

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি 



















