, সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
বাস চালক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সিলেটের ৩ জেলায় বাস চলাচল বন্ধ জুলাই বৈষম্যহীন দেশ গড়ার চেতনা : খান মো. রেজা-উন-নবী ‘সিলেট নগরীকে পর্যায়ক্রমে ভিক্ষুক মুক্ত করা হবে’ সিলেটে পুলিশের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ অধ্যাপক ডাক্তার মোহাম্মদ আফজল মিয়ার ইন্তেকাল : বিভিন্ন মহলের শোক সিলেট-চারখাই-শেওলা চারলেন প্রকল্প বাতিলের ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবেনা : ড. মো: এনামুল হক চৌধুরী বিশ্বনাথে এসএসসি ও দাখিল কৃতি শিক্ষার্থীকে ছাত্র মজলিসের সংবর্ধনা তারেক রহমানকে নিয়ে নাদেলের কটুক্তির প্রতিবাদে সিলেট জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় গোলাপগঞ্জে মাদকসহ একই পরিবারের ৪ জনসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার জকিগঞ্জে ধানক্ষেত থেকে বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার
বিজ্ঞাপন :
সকল জেলায় সাংবাদিক নিয়োগ চলছে

ওসমানীনগরে ৭ কোটি টাকার ওয়াশব্লক প্রকল্পে অনিয়ম!

সিলেটের ওসমানীনগরে ৮টি ইউনিয়নের ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকার ওয়াশব্লক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাজ শেষ না করেই কাজ হস্তান্তর, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণ কাজে ত্রুটি ও দীর্ঘ দিন ধরে কাজ ফেলে রাখাসহ রয়েছে বহু অভিযোগ। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের এতো বড় প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়ে আসলেও তা যেন দেখার মতো কেউ নেই।

সিলেট জেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পিইডিপি-৪ এর আওতায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে শিক্ষার্থীদের জন্য জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পৃথক ৪টি প্যাকেজে ওসমানীনগরে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ পায় সোনালী সিন্ডিকেট (প্যাকেজ নং-১২৩৫), মেসার্স এমইপি এটিএম জেবি (প্যাকেজ নং-১২১৯), সেতু এন্টারপ্রাইজ (প্যাকেজ নং-১২১৮-) ও মো. সাদেকুর রহমান (প্যাকেজ নং-২০২২) নামের চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তালিকাবদ্ধ ঠিকাদাররা কাজ পেলেও প্রকল্পের নির্দিষ্ট কোন তথ্যও দিতে পারছেন না তারা। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গেলে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়েও প্রায় একই অবস্থা দেখা যায়। বিরক্তি হয়ে কিছু তথ্য দিলেও কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া হয় প্রায় ৪ থেকে ৫ মাস আগের। তথ্য দেয়া হয় নি ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটের ফেলে রাখা কাজের। সরেজমিন বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে ওয়াশব্লকের নির্মাণ কাজ শুন্যের কোটায়  অথবা আংশিক হয়েছে বলে জানা গেছে। সেগুলোর ব্যাপারে সরকারি দপ্তরের নথিতে চরম অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কাজই হয়নি এমন একাধিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক কাজের অগ্রগতি ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এমন উদ্ভট অগ্রগতি প্রতিবেদনের বিপরীতে তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের কাজের চেয়ে বেশিরভাগ টাকা। এমন বিষয় নিয়ে উপজেলা বা জেলা অফিসের কেউ কথা বলতে আগ্রহী হননি। এমনকি কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চাইছেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনালী সিন্ডিকেটের প্যাকেজে ২০টি ওয়াশব্লক কাজের ১৫টিই ওসমানীনগরের বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। কাজ শুরু না হলেও উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণ কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পন্ন ওয়াশব্লকের অগ্রগতি দেখানো ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ । এমন মনগড়া তথ্যের প্রতিবেদন দাখিল করে প্রকল্পের ১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৫৫ শতাংশ।

মোহাম্মদ মোবারক আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশিষ আচার্য বলেন, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে অনেকবার যোগাযোগ করলেও কোন সুফল পাই নি। পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমানের এমন বক্তব্য।

একই অর্থ বছরে মেসার্স এমইপি-এটিএম জেবি ওসমানীনগরে ৫টি ওয়াশব্লকের কাজ পায়। এই প্রকল্পের কাজগুলো শতভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং কাজের মান খারাপ বলে জানিয়েছেন একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অধীনে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

সাদেকুর রহমান ঠিকাদারের প্যাকেজে ওসমানীনগরে ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়াশব্লকের কাজ রয়েছে। জায়ফরপুর ও দামদর্শি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে অসম্পূর্ণ কাজ। কিন্তু শতভাগ কাজ সম্পন্ন না করেই সুকৌশলে কাজগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা। কাজ বুঝে পাওয়ার নথিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা স্বাক্ষর দিতে না চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের অনুরোধপূর্বক স্বাক্ষরে ‘বাধ্য’ করেন। এ বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

নিজ করনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণেশ রঞ্জন বলেন, কাজ শেষ না করে হস্তান্তরের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিতে আসলে তিনি সম্মত হননি। এক পর্যায়ে  কমিটির সহ-সভাপতিকে দিয়ে অনুরোধ করান উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। শেষ পর্যন্ত কমিটির অনুরোধে স্বাক্ষর করলেও অসমাপ্ত কাজগুলো এখনো হয়নি।

সেতু এন্টারপ্রাইজের ১৫টি ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ প্রকল্পের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। মুক্তারপুর ও কাগজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত গভীর নলকুপ দিয়ে পানি না উঠাসহ কাজ অসাপ্ত রয়েছে মর্মে জানিয়েছেন দুই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ।

এছাড়া হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেট নির্মাণ প্রকল্পের সাদিপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, প্রথমপাশা জামেয়া মোহাম্মদিয়া আবাসিক মাদরাসা, খাইয়া খাইড় হাফিজিয়া ইবতেদায়ী মাদরাসা, ময়নাবাজার ও হাজীপুর বাজারের নির্মাণাধীন ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটগুলো নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসে বারবার যোগাযোগ করেও কোন সুফল পাচ্ছেন না। গত বছর এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলা অফিস। বরাদ্দের সকল টাকা তুলে নেয়া হয়েছে কি না, যথাযথ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন অফিসের কর্তা ব্যক্তিরা।

রংবরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লকের কাজে অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এবং শিক্ষা অফিসে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। অভিযোগে বেশ কয়েকটি ত্রুটি উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন করে মন্তব্য বইতে এ নিয়ে মন্তব্য লিখে গেছেন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে তিনি নিজে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ঠিকাদার সাদেকুর রহমান বলেন, ওসমানীনগরের কাজগুলো অনেক আগেই শেষ করেছি।

সেতু এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী সৈয়দ তৈমুর বলেন, তাঁর কাজের ওসমানীনগরের সাইট দেখেন উজ্জ্বল নামের একজন। এর বাইরে আর কোন তথ্য দেননি তিনি।

সোনালী সিন্ডিকেটের স্বত্ত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন বলেন, তাঁর কাজগুলো করছে মনির নামের একজন।

ওসমানীনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সানাউল হক সানি বলেন,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কাজ বা সমস্যা আছে তা তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকেও অবগত করেছেন। তবে সেখানে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসের অনিয়মের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করছেন কি না, তা জানা যায়নি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ দিদারুল ইসলাম কায়েস বলেন, বন্যার কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। এখন তারা আবার কাজ শুরু করবে। প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, কাজগুলোতো করে দেওয়া হবে। এর বেশি তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ বিলম্বের ব্যাপারে মৌখিকভাবে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দ্রুত সে কাজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মুহাম্মদ শেখ সাদি রহমত উল্ল্যাহ বলেন, বিষয়টি নোট করে রেখেছি। এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ প্রদানের পরামর্শও দেন তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সাংবাদিকদের জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জনপ্রিয়

বাস চালক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সিলেটের ৩ জেলায় বাস চলাচল বন্ধ

ওসমানীনগরে ৭ কোটি টাকার ওয়াশব্লক প্রকল্পে অনিয়ম!

প্রকাশের সময় : ০৩:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

সিলেটের ওসমানীনগরে ৮টি ইউনিয়নের ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকার ওয়াশব্লক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাজ শেষ না করেই কাজ হস্তান্তর, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণ কাজে ত্রুটি ও দীর্ঘ দিন ধরে কাজ ফেলে রাখাসহ রয়েছে বহু অভিযোগ। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের এতো বড় প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়ে আসলেও তা যেন দেখার মতো কেউ নেই।

সিলেট জেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পিইডিপি-৪ এর আওতায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে শিক্ষার্থীদের জন্য জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পৃথক ৪টি প্যাকেজে ওসমানীনগরে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ পায় সোনালী সিন্ডিকেট (প্যাকেজ নং-১২৩৫), মেসার্স এমইপি এটিএম জেবি (প্যাকেজ নং-১২১৯), সেতু এন্টারপ্রাইজ (প্যাকেজ নং-১২১৮-) ও মো. সাদেকুর রহমান (প্যাকেজ নং-২০২২) নামের চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তালিকাবদ্ধ ঠিকাদাররা কাজ পেলেও প্রকল্পের নির্দিষ্ট কোন তথ্যও দিতে পারছেন না তারা। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গেলে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়েও প্রায় একই অবস্থা দেখা যায়। বিরক্তি হয়ে কিছু তথ্য দিলেও কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া হয় প্রায় ৪ থেকে ৫ মাস আগের। তথ্য দেয়া হয় নি ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটের ফেলে রাখা কাজের। সরেজমিন বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে ওয়াশব্লকের নির্মাণ কাজ শুন্যের কোটায়  অথবা আংশিক হয়েছে বলে জানা গেছে। সেগুলোর ব্যাপারে সরকারি দপ্তরের নথিতে চরম অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কাজই হয়নি এমন একাধিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক কাজের অগ্রগতি ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এমন উদ্ভট অগ্রগতি প্রতিবেদনের বিপরীতে তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের কাজের চেয়ে বেশিরভাগ টাকা। এমন বিষয় নিয়ে উপজেলা বা জেলা অফিসের কেউ কথা বলতে আগ্রহী হননি। এমনকি কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চাইছেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনালী সিন্ডিকেটের প্যাকেজে ২০টি ওয়াশব্লক কাজের ১৫টিই ওসমানীনগরের বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। কাজ শুরু না হলেও উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় কয়েকটি বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণ কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পন্ন ওয়াশব্লকের অগ্রগতি দেখানো ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ । এমন মনগড়া তথ্যের প্রতিবেদন দাখিল করে প্রকল্পের ১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৫৫ শতাংশ।

মোহাম্মদ মোবারক আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশিষ আচার্য বলেন, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে অনেকবার যোগাযোগ করলেও কোন সুফল পাই নি। পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমানের এমন বক্তব্য।

একই অর্থ বছরে মেসার্স এমইপি-এটিএম জেবি ওসমানীনগরে ৫টি ওয়াশব্লকের কাজ পায়। এই প্রকল্পের কাজগুলো শতভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং কাজের মান খারাপ বলে জানিয়েছেন একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অধীনে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

সাদেকুর রহমান ঠিকাদারের প্যাকেজে ওসমানীনগরে ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়াশব্লকের কাজ রয়েছে। জায়ফরপুর ও দামদর্শি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে অসম্পূর্ণ কাজ। কিন্তু শতভাগ কাজ সম্পন্ন না করেই সুকৌশলে কাজগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা। কাজ বুঝে পাওয়ার নথিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা স্বাক্ষর দিতে না চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের অনুরোধপূর্বক স্বাক্ষরে ‘বাধ্য’ করেন। এ বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

নিজ করনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণেশ রঞ্জন বলেন, কাজ শেষ না করে হস্তান্তরের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিতে আসলে তিনি সম্মত হননি। এক পর্যায়ে  কমিটির সহ-সভাপতিকে দিয়ে অনুরোধ করান উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। শেষ পর্যন্ত কমিটির অনুরোধে স্বাক্ষর করলেও অসমাপ্ত কাজগুলো এখনো হয়নি।

সেতু এন্টারপ্রাইজের ১৫টি ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ প্রকল্পের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। মুক্তারপুর ও কাগজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত গভীর নলকুপ দিয়ে পানি না উঠাসহ কাজ অসাপ্ত রয়েছে মর্মে জানিয়েছেন দুই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ।

এছাড়া হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেট নির্মাণ প্রকল্পের সাদিপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, প্রথমপাশা জামেয়া মোহাম্মদিয়া আবাসিক মাদরাসা, খাইয়া খাইড় হাফিজিয়া ইবতেদায়ী মাদরাসা, ময়নাবাজার ও হাজীপুর বাজারের নির্মাণাধীন ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটগুলো নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসে বারবার যোগাযোগ করেও কোন সুফল পাচ্ছেন না। গত বছর এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলা অফিস। বরাদ্দের সকল টাকা তুলে নেয়া হয়েছে কি না, যথাযথ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন অফিসের কর্তা ব্যক্তিরা।

রংবরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লকের কাজে অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এবং শিক্ষা অফিসে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। অভিযোগে বেশ কয়েকটি ত্রুটি উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন করে মন্তব্য বইতে এ নিয়ে মন্তব্য লিখে গেছেন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে তিনি নিজে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ঠিকাদার সাদেকুর রহমান বলেন, ওসমানীনগরের কাজগুলো অনেক আগেই শেষ করেছি।

সেতু এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী সৈয়দ তৈমুর বলেন, তাঁর কাজের ওসমানীনগরের সাইট দেখেন উজ্জ্বল নামের একজন। এর বাইরে আর কোন তথ্য দেননি তিনি।

সোনালী সিন্ডিকেটের স্বত্ত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন বলেন, তাঁর কাজগুলো করছে মনির নামের একজন।

ওসমানীনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সানাউল হক সানি বলেন,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কাজ বা সমস্যা আছে তা তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকেও অবগত করেছেন। তবে সেখানে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসের অনিয়মের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করছেন কি না, তা জানা যায়নি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ দিদারুল ইসলাম কায়েস বলেন, বন্যার কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। এখন তারা আবার কাজ শুরু করবে। প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, কাজগুলোতো করে দেওয়া হবে। এর বেশি তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ বিলম্বের ব্যাপারে মৌখিকভাবে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দ্রুত সে কাজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মুহাম্মদ শেখ সাদি রহমত উল্ল্যাহ বলেন, বিষয়টি নোট করে রেখেছি। এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ প্রদানের পরামর্শও দেন তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সাংবাদিকদের জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।