অব্যবস্থাপনা-অসংগতি-বছরের পর বছর সংস্কারহীনতায় বিপর্যস্ত আন্তর্জাতিক করিডরপথ
সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক একসময় চার লেনে উন্নীত হওয়ার আশায় মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগপথ হিসেবে ব্যবহৃত ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি আজ ভাঙাচোরা, ধসে পড়া, গভীর গর্ত আর বেপরোয়া উল্টো লেন ব্যবহারের কারণে একেবারে ‘মরণফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা; বড় দুর্ঘটনা ঘটলে খবর হয়, আর অগণিত ছোট দুর্ঘটনা থাকে আড়ালে।
জৈন্তিয়া গেইট পেরোতেই চোখে পড়ে সড়কের ভয়াবহ চেহারা কার্পেটিং উঠে গেছে, পাথর সরে গেছে, কোথাও রাস্তার অংশ পুরো বসে গেছে। বিশেষ করে দরবস্ত, সারিঘাট, রাংপানি, কদমখাল ও আসামপাড়া-বাংলাবাজার-বাঘের সড়ক এলাকায় গর্ত এত গভীর যে সামান্য ভুলেই বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেক গাড়ি প্রতিদিনই এসব গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
গর্ত এড়াতে চালকদের অনেকেই ডান পাশে উঠে যান, আর এই উল্টো লেন ব্যবহারের প্রবণতাই বাড়াচ্ছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। জৈন্তাপুরের শ্রীখেল এলাকায় ২০২৩ সালের দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনো তাজা-ভাঙা রাস্তা এড়াতে ডানদিকে উঠে যাওয়া একটি বাসের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান পাঁচজন; আহত হন আরও ১৫ জন। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘এ রাস্তায় এমন ঘটনা এখন খুবই সাধারণ।’
ছয়-সাত বছর ধরে সড়ক ভাঙছে, নেই সংস্কার
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বহুদিন ধরে রাস্তা ভেঙে পড়ছে। আড়াই বছর আগে নামমাত্র কিছু সংস্কার হলেও তা বর্ষার প্রথম ঝড়েই উঠে যায়। সওজ ও চার লেন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মধ্যে ‘দায়িত্ব কার?’—এই প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সওজ বলছে সড়কটি এখন চার লেন প্রকল্পের আওতায়, আর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে বাজেট নেই—ফলে বছরের পর বছর কোনো স্থায়ী সংস্কার হয়নি।
সেতুতেও ফাটল, যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা
দরবস্ত বাজারসংলগ্ন সেতুর অ্যাপ্রোচে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশঙ্কা সেতুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে পুরো তামাবিল–সিলেট যোগাযোগ এক ঝটকায় বন্ধ হয়ে যাবে। কেবল যান চলাচল নয়, বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ও ঘটতে পারে।
চার লেন প্রকল্প কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ
২০২০ সালে শুরু হওয়া চার লেন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। চারটি প্যাকেজের একটির কাজও দৃশ্যমান নয়। প্রকল্প ঝুলে থাকায় সওজও স্থায়ী সংস্কার করতে পারছে না।
‘অতিরিক্ত ওজন আর আইন না মানাই দুর্ঘটনার কারণ’ – প্রকল্প পরিচালক
সিলেট সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মো. নাজমুল হুদা বলেন,
‘অতিরিক্ত ওজনবাহী ট্রাক আর ডানদিক দিয়ে গাড়ি চলাচলই মূল সমস্যা। আইন মানা হয় না। তাই দুর্ঘটনা বাড়ছে।’
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত অংশে জরুরি সংস্কারের জন্য অর্থ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে, এবং বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে এমন ইঙ্গিতও মিলেছে। এক মাসের মধ্যে কিছু কাজ শুরু করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
জরুরি সংস্কার ছাড়া উপায় নেই
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষায়, ‘এটি আর শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, মানুষের জীবনরক্ষার প্রশ্ন।’
চার লেন প্রকল্পের দেরি, সওজের সীমাবদ্ধতা, বরাদ্দহীনতা এবং প্রশাসনিক জটিলতায় সড়কটি আজ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক করিডর হওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে পরিণত হয়েছে।
সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা ইঙ্গিত দিচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার ছাড়া যেকোনো সময় বড় দুর্যোগ ঘটতে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদক 



















