বৈশাখ মাসজুড়ে কৃষক পরিবারে উৎসবের আমেজে ভাটা পড়েছে বজ্রপাতের আতঙ্কে। প্রায় প্রতিদিনই হাওরে ধান কাটতে ও খলায় শুকানোর সময় হঠাৎ শুরু হওয়া বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রাঘাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন কৃষক ও শ্রমিকরা।
জানা গেছে, বজ্রপাত প্রতিরোধে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় প্রতিবছরেই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। অন্যদিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।
জেলার সচেতন মহল বলছে, হাওরাঞ্চলের কৃষকরা যদি আবহাওয়া ও বজ্রপাতের আগাম তথ্য পাচ্ছে না। এ ছাড়া অসচেতনতার জন্য বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকেই। নিহতদের বেশির ভাগের পেশা কৃষি, হাওরে মাছধরা ও দিনমজুর।
সরকারিভাবে বজ্রপাত নিরোধে যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য ও ধীরগতির।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত ১১ বছরে (২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বৈশাখ মাসে থেকে বর্ষার সময়) ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রান্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিশু, নারী, কিশোর, যুবক, জেলে রয়েছে।
চৈত্র থেকে আষাঢ় (মার্চ-মে) মাস পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়। এই সময়ের মধ্যেই বোরো ফসল ঘরে তুলতে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করার পর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিকে পুরো হাওরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেলে মাছ ধরেন জেলেরা। এ সময়ে বজ্রাঘাতে আহত ও নিহত হন কৃষক এবং জেলেরা।
সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত জেলার সুনামগঞ্জ সদরে ৭ জন, বিশ্বম্ভরপুরে ১ জন, তাহিরপুরে ৯ জন, জামালগঞ্জে ২ জন, ধর্মপাশায় ৭ জন, শান্তিগঞ্জ ৬ জন, জগন্নাথপুরে ৪ জন, দিরাইয়ে ১৭ জন, শাল্লায় ৮ জন, দোয়ারা বাজার ৪ জন, ছাতকে ২ জনসহ মোট ৬৮ জন বজ্রাঘাতে মারা যান।
এ ছাড়া জেলায় ২০১৫ সালে ৩৭ জন, ২০১৬ সালে ২০ জন ও ২০১৭ সালে ১১ জন, ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ৯ জন, ২০২০ সালে ১১ জন, ২০২১ সালে ১১ জন, ২০২২ সালে ১৯ জন, ২০২৩ সালে ১০ জন, ২০২৪ সালে ৭ জন এবং চলতি বছর গতকাল বুধবার (৩০ এপ্রিল) পর্যন্ত ৬ জনসহ ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বজ্রপ্রবণ এলাকার মধ্যে সুনামগঞ্জ অন্যতম। ২০১৭ সালে নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয় মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সুনামগঞ্জ এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। এ জেলায় প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৫টিরও বেশি বজ্রপাত হয়।
জেলার শনি হাওর পাড়ের কৃষক সাদেক আলী জানান, বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় বৃষ্টি, বজ্রপাত। এরপর পুরো বর্ষায় চলমান থাকে। সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের কারণে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হয়। এ সময় বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণকারীর পরিবারকে সরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হয় তা পরিবারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তির তুলনায় কিছুই না। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করে পরিবারগুলো।
কৃষক সাকিল মিয়া জানান, হাওরে নিরাপত্তা শেড নির্মাণ ও বজ্রপাত প্রতিরোধে নিরোধক দণ্ড প্রয়োজনের তুলনায় কম। হাওরে কাজ করতে গিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যু ভয় কাজ করে। আগে এত বজ্রপাত হতো না। গত কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলছে। আর মৃত্যু ও হচ্ছে। দ্রুত এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজাউল করীম জানান, হাওর বেষ্টিত এলাকায় বজ্রাঘাতে প্রাণহানির পরিমাণ অনেক বেশি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্টের মাধ্যমে বিভিন্ন হাওরে বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা পেতে ১০-১২ শেড নির্মাণ করা হয়েছে, আরো হবে। সরকার বজ্রাঘাতে প্রাণহানি কমাতে চেষ্টা করছে এবং সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সেমিনারও করা হচ্ছে।