সিলেটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় আসামির জামিনের বিরোধিতা করায় বাদীকে আদালত এলাকা থেকে অপহরণ করে মারধর ও জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর আদায় করেছে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতারা। এ ঘটনায় আহত বাদীকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
মামলার বাদী কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
বাদী এয়ারপোর্ট থানার ভবাইরবাড়ী গ্রামের ময়না মিয়ার ছেলে মো. কয়ছর আহমদ। গত ৪ঠা আগস্ট নগরের নয়া সড়কে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছিল। এই দিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়া সড়ক ও আশপাশ এলাকা। পুলিশ সদস্যরা নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। এর আগে আওয়ামী লীগ সহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ছাত্র-জনতার। এদিন ছাত্র-জনতার পক্ষে আন্দোলনে গিয়ে পায়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন কয়ছর আহমদ। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ৭ই নভেম্বর তিনি বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার ওই মামলার ৫৮ নম্বর আসামি জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দপুরের বাসিন্দা সৈয়দ জুয়েল মিয়া। মামলার আসামি হওয়ার পর থেকে জুয়েল সহ কয়েকজন মামলা তুলে নিতে বাদীকে হুমকি দেন।
এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ৯ই এপ্রিল নগরের এয়ারপোর্ট থানায় জুয়েল সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেন কয়ছর আহমদ। জিডি দায়েরের পর গত ১৭ই এপ্রিল রাতে সিলেটের র্যাব-৯ এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে সৈয়দ জুয়েল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে রয়েছেন বাদী জুয়েল মিয়া।
মামলার আসামি পক্ষ জুয়েল মিয়ার জামিনের প্রার্থনা করলে রোববার সিলেটের এমএম-১ আদালতে এর শুনানি হয়। শুনানিকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন মামলার বাদী কয়ছর আহমদ। তিনি ও তার আইনজীবী আদালতে জামিনের বিরোধিতা করলে আদালত শুনানি শেষে জামিন মঞ্জুর করেননি।
বাদীপক্ষে আইনজীবী এডভোকেট অমরেনন্দ নারায়ণ ভট্টাচার্য মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ওইদিন এজলাসের বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি থাকায় তিনি বাদীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এজলাসের ভেতরে বেঞ্চে বসিয়ে পাশের একটি কোর্টে যান। ফিরে এসে তিনি ওই স্থানে বাদীকে পাননি। পরে বিষয়টি জানান বাদীর আত্মীয়স্বজনকে। পরে শুনেছেন বাদীকে অপহরণ করে মারধর করা হয়েছে।
আদালতে উপস্থিত থাকা বাদীর স্বজনরা জানিয়েছেন, আদালত এলাকায় তারা বাদীকে না পেয়ে অনুসন্ধান চালান। এ সময় তারা আদালত এলাকায় আসামি পক্ষের ২০ থেকে ২৫ জন লোককে পেলেও বাদীকে পাননি। তাকে আদালত এলাকা থেকে সরিয়ে নেয় অপহরণকারীরা। মামলার বাদী কয়ছর আহমদ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, এজলাসের ভেতর থেকে তাকে পরিচিত একজনকে দিয়ে বাইরে ডেকে আনে জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা মিল্লাত আহমদ চৌধুরী ও তার লোকজন। বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা ধরে নিয়ে নিচে চলে আসে।
একপর্যায়ে তারা আদালত প্রাঙ্গণের একটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এ সময় কয়েকজন মিলে তাকে মারধর করে। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় তিনি স্বজনদের সহযোগিতা চাইতে পারেননি। পরে তিনটি স্ট্যাম্পে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়। বিকাল ৩টার দিকে মোটরসাইকেল যেতে তাকে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্ট এলাকায় চলে যায়। ওখানে তাকে ছেড়ে দিয়ে অপহরণকারীরা চলে যায়। তিনি জানান, তাদের মারধরের কারণে রাতে তিনি বুকে ও মাথায় ব্যথা অনুভব করলে পরদিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। মঙ্গলবার তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আসামি পক্ষের লোকজনের মারধরের ঘটনায় তিনি এখনো অসুস্থ বলে জানান।
এ ঘটনায় সিলেটের কোতোয়ালি থানা একটি লিখিত এজাহার দাখিল করেছেন। এজাহারে তিনি মিল্লাত ছাড়া তার সহযোগী লুৎফুর রহমান, হুমায়ূন কবির, আব্দুল খালিক, আসাদ আলী, সৈয়দ ইমন মিয়া, হারুন মিয়া, সৈয়দ আব্দুল মালিক, কলফ উদ্দিন, মো. জহির উদ্দিন, ইউসূফ মিয়া নুনু, কবির হোসেন সুয়া সহ ১০-১২ জনকে আসামি করেছেন।
কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে, বাদীর অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা পেলে এ ব্যাপারে আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
বাদীর স্বজনরা জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী মামলা দায়েরের পর থেকে বাদীর ওপরে হামলা চালাতে বিভিন্ন সময় আসামি পক্ষের লোকজন টার্গেট করেছিল। বিষয়টি টের পাওয়ার পর বাদী নিজে এয়ারপোর্ট থানায় উপস্থিত হয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন। অপহরণ ও মারধরের ঘটনায় বাদী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান তারা।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর ও শাহজালাল ফাঁড়ির তদন্ত ইনচার্জ আজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, পূর্বের মামলার কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ কারাগারে আছেন। ওই মামলার তদন্ত চলমান আছে।