দুই দিনের বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে হাকালুকি হাওর সহ নদী-তীরের নিম্নাঞ্চল। বাড়তে শুরু করেছে খরশ্রুতা মনু, ধলাই, ফানাই ও সোনাই নদীর পানি।
জুড়ী নদীর পানি ইতিমধ্যে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু বন্যার পদধ্বনি শুরু হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া প্রকল্পের কাজ চলছে ধীর গতিতে। হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের জুন মাসে। কিন্তু মে ২০২৫ মাসে এসে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলাকে বন্যা মুক্ত রাখতে হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৫৭ শতাংশ।
অথচ বন্যার আগাম সতর্কতা জারি করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে, মনু নদীর ভাঙণ হতে মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলাকে রক্ষা করার লক্ষে ২০২২ সালে ৯৯৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরে চর অপসারণ বাধ মেরামত ফ্লাড ওয়াল নির্মাণ পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজের ৭২টি প্রকল্প টেন্ডার করে কাজ শুরু করা হয়।
জানা যায়, মনু নদীর বাঁধের কাজ চলছে ৪ বছর থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসএফের বাধা, জমি অধিগ্রহণ ও অর্থ সংকট জটিলতায় ৫০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে। ২০২১ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যথা সময়ে শেষ না হওয়ায় ২ দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় ফের বন্যার আশঙ্কা করছেন উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ।
জানা জায়, গত বছর বর্ষা মৌসুমে টানা ভারী বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলায় মনু নদীর পৃথক পৃথক স্থানে একাধিক ভাঙন দেখা দেয়।
ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পনি প্রবেশের কারণে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি ও ফিসারী। গৃহহীন হয়ে আশ্রয় কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয় বন্যাকবলিতদের। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়তে হয় তাদের।
ভুক্তভোগীরা জানান ওই সময় একাধিক স্থানে প্রতিরক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবেশ করলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানো হয়। তারপরও টিলাগাঁও ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের গুদামঘাট নামক স্থানে প্রায় ৬০০ ফুট বাঁধ ও মিয়ারপাড়া এলাকায় ৩০০ ফুটের মতো বাঁধ ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া ডেমা বিল এলাকায় ১০০ ফুটের মতো ভাঙনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়, লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
গতবছর বাঁধের কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও এ বছর আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মনু নদীতে পানি বৃদ্ধির সময় টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রাম, মিয়ারপাড়া, সন্দ্রাবাজ ও খন্দকারের গ্রাম, হাজীপুর (গুদামঘাট) এলাকা। হাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর, দাউদপুর, সাধনপুর, মন্দিরা ও কাউকাপন বাজার এলাকা। শরীফপুর ইউনিয়নের তেলিবিল ও চানপুর এলাকা এবং পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া, বেলেরতল, ছৈদল বাজার, রাজাপুর (কলিকোনা) এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো ভাঙনের কবলে পড়বে বলে এলাকাবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ গত বছরের ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে পানি উন্নয়ন বোর্ড আগাম ব্যবস্থা নেয়ার কথা, কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
আশ্রয়গ্রাম এলাকায় বাঁধে নতুন মাটি ভরাট করা হয়েছে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের পানির চাপ কতটুকু নিতে পারবে এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেখানের স্থানীয় বাসিন্দারা।
মৌলভীবাজার জেলা পাউবো সূত্রে জানা যায়, নদী ভাঙন মুক্ত রাখতে কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর, হাজীপুর, পৃথিমপাশা ও টিলাগাঁও ইউনিয়নে ২৮টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে। যার চুক্তিমূল্য ৩০৭ কোটি টাকা। ২৮টি প্যাকেজের মধ্যে স্থায়ী তীর-প্রতিরক্ষা কাজের ২০টি, চর অপসারণ কাজের ৪টি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনরাকৃতীকরণ কাজের ৪টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে। ২০২১ সালে কাজ শুরু করে এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের প্রায় চার বছর হলেও কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। মেয়াদ শেষ হলে ২ দফায় সময়ও বাড়ানো হয়েছে। এদিকে সীমান্তবর্তী কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ বিএসএফের বাধার কারণে বন্ধ রয়েছে।
টিলাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত জানান, টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রাম, মিয়ারপাড়া, সন্দ্রাবাজ ও খন্দকারের গ্রাম, হাজীপুর (গুদামঘাট) এলাকার নদীর বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। মনু নদীর গত বছরের ভাঙন স্থান হাজীপুর (গুদামঘাট) ও মিয়ারপাড়া মাটি ভরাট করে ব্লক দেয়া হয়েছে তবে কাজ এখনো বাকি রয়েছে।
পৃথিমপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, মনু নদীর শিকড়িয়া (ডেমা বিল) এলাকায় গত বছর ১০০ ফুটের মতো ভাঙনের সৃষ্টি হয়। বাঁধের কাজ বিএসএফের বাধার কারণে এখনো করা হয়নি। পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া, বেলেরতল, ছৈদল বাজার, রাজাপুর (কলিকোনা) এলাকা প্রতিরক্ষা বাঁধ সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে শিকড়িয়ার ভাঙনটি ভরাট না হওয়ায় ওই এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছেন।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, অনেক এলাকায় স্থানীয় লোকজনের বাধার কারণে বন্যা প্রতিরক্ষা বাধের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ঝুকিমুক্ত রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।